মইনুল আলমের মাংসি:
ম্রো—নৃগোষ্ঠী ও বান্দরবানের স্মৃতিজাগানিয়া ছবি
মুয়িন পারভেজ

বাংলাদেশে যে—কজন আলোকচিত্রী প্রান্তিক জনজীবন নিয়ে নিভৃতে নিরবচ্ছিনড়বভাবে কাজ ক’রে যাচ্ছেন, শিল্পী মইনুল আলম (জ. ১৯৬২) তাঁদের একজন। ২০০১ সালে সমুদ্রোপকূলবতীর্ দরিদ্র জেলেদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের ছবি নিয়ে কোডেক পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম আলোকচিত্রের বই: ছবিতে বাংলাদেশের জেলে জীবন ও জীবিকা। বান্দরবানের ম্রো—নৃগোষ্ঠীর চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের উৎসব ‘চাংক্রান পই’য়ের শাদাকালো আলোকচিত্র নিয়ে ২০২১ সালে পূর্বস্বর থেকে প্রকাশিত হয়েছে চাংক্রান পই। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হলো ম্রোদের নিয়েই নতুন আলোকচিত্রের বই: মাংসি। বোঝা যায়, সমাজের নিমড়ববর্গের জনজীবনই মইনুল আলমকে আকৃষ্ট করেছে গভীরভাবে। দুশো বত্রিশ পৃষ্ঠার এই বইয়ের সব ছবি ৩৫ মিমি ফিল্মে তোলা। প্রায় সাতাশ বছর আগেকার দিনের ম্রোদের জীবনযাপন ও বান্দরবানের নিসর্গ চমৎকারভাবে বইটিতে ফুটে উঠেছে। ছবিগুলো রংবিন্যাসে যেমন চিত্তাকর্ষক, ধারণকৌশলে তেমনি বাঙ্ময়।
‘চাংক্রান পই’—উপলক্ষ্যে প্রতিবছর মেলা বসে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার সাবেক বিলছড়ি মৌজায়, মাতামুহুরী নদীর ধারে। মইনুল আলম এই উৎসবকেন্দ্রিক মেলার প্রথম ছবি তোলেন ২০১৬ সালে। পরবতীর্ বছর সেই ছবিগুলো বাছাই ক’রে তিনি সাবেক বিলছড়িতেই চিত্রভাষায় চাংক্রান পই নামে একটি একক চিত্রপ্রদর্শনের আয়োজন করেন। ছবির মানুষগুলোই নিজেদের বিচিত্র ভঙ্গিমা ও সাজপোশাকের টাঙানো ছবি দেখে, ছবিতে নিজেদের অন্যরকমভাবে ফিরে পেয়ে, অনির্বচনীয় আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন সেবার। ব্যতিক্রমী এমন চিত্রপ্রদর্শন ইতিপূর্বে বাংলাদেশে হয়েছে কি না জানা নেই। বাংলা একাডেমি—প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: বান্দরবান (২০১৪) বইয়ে ‘চাংক্রান পই’য়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকলেও সাবেক বিলছড়িতে অনুষ্ঠিত ম্রোদের প্রাচীন মেলাটির কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।
দুশোরও বেশি রঙিন আলোকচিত্রে শোভিত মাংসি—তে ম্রোদের নিত্যদিনের জীবনচর্যা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ ও সাজগোজ, দূরের পথে দল বেেঁধ পায়ে হেঁটে বা নৌকায় হাটে যাওয়া, মাতামহুরীর তীরে সামান্য ভাতমাছ রানড়বা ক’রে খাওয়াদাওয়া, ধমীর্য় ও সামাজিক রীতিনীতি, উৎসব—নানা শ্রেণি ও বিষয়ের ছবি ধারাবাহিকভাবে পরিস্ফুট হয়েছে পাতায়—পাতায়। শান্তস্বভাব ম্রো—জনগোষ্ঠীর অনাড়ম্বর জীবনযাপন মইনুল আলমের মনে যে স্থায়ী রেখাপাত করেছে, পর—পর প্রকাশিত তাঁর দুটি ম্রো—কেন্দ্রিক আলোকচিত্রের বই সে—কথাই প্রমাণ করে।
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে চারুকলায় সড়বাতকোত্তর মইনুল আলমের আলোকচিত্রজগতে আবির্ভাব ঘটে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। মাংসি—র ভূমিকায় জানা যায়, বরেণ্য আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন (১৯৪৮—২০১৮) ফ্রান্সযাত্রার আগে তাঁর নিকন এফ৩এক্স ক্যামেরাটি মইনুল আলমের কাছে বিক্রি করেন। এই পুরোনো ৩৫ মিমি ফিল্ম ক্যামেরা নিয়েই মইনুল আলমের আলোকচিত্র—অভিযানের শুরু, যদিও ছবি তোলার প্রথম প্রণোদনা পেয়েছেন কৈশোরেই, তাঁর বাবা খ্যাতিমান চিকিৎসক ও অভিনেতা এ. বি. এম. নুরল আলমের (১৯২৫—২০০৩) কাছে। চট্টগ্রামের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হীরামন—এ (১৯৬৭) এ. বি. এম. নুরল আলম বিশিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নিয়মিত মঞ্চনাটকে অভিনয় ও নাট্যনির্দেশনার পাশাপাশি তাঁর ছিল ছবি তোলার শখ। ষাট—সত্তরের দশকের চট্টগ্রাম শহর, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের পথঘাট, চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০—১৯৭৫) আগমন এবং আন্দোলনকামী জনতা ও বিভিনড়ব জনসভার ছবি (১৯৬৯) তুলেছেন শাদাকালো ফিল্মে, তাঁর নিজস্ব ফিল্ম ক্যামেরায়। পূর্বস্বর—প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথার বই অতীত যখন মুখর সঙ্গী—তে (২০১৯) এসব তথ্যঋদ্ধ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।
মাংসি—র ছবিগুলোতে বিশেষভাবে চোখে পড়বে সরল শিশুদের মুখ। গাঁয়ের ধুলোমাখা পথে লুঙ্গিশার্টপরা তিনটি শিশু ইস্কুলে যাচ্ছে—পিতলের ঘণ্টাও ঝুলছে একজনের হাতে। বাবার হাত ধ’রে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে এক অবুঝ শিশু। শিশুটির ব্যাকুল একজোড়া চোখ
মুহূর্তেই মন কেড়ে নেয় আলোছায়া ও বস্তুসংস্থানের নৈপুণ্যের কারণে। চিত্রশিল্পী মইনুল আলম যেন ছবি এঁকেছেন ক্যামেরার ক্যানভাসে—শুধু মাধ্যমের বদল ঘটেছে, অন্তদৃর্ষ্টির নয়।
ম্রো—ভাষায় ‘মাংসি’ মানে সবুজ রং। উৎসবের আগে ম্রো ছেলেমেয়েরা কাপড়ে লাল রং (রাংসি) ও সবুজ রং (মাংসি) লাগায়। পুরোনো দা—কে জলে ভিজিয়ে তার উপর কচি বাঁশে আগুনের ছ্যাঁক দিলে কালচে তরল তৈরি হয়। গরম অবস্থায় সেই তরল আঙুলে তুলে নিয়ে দাঁতে লাগান ম্রোরা। বিশেষ—উপায়ে—তৈরি এই প্রাকৃতিক রঙের নাম ‘চুলি’। রং লাগানোর পর এক সপ্তাহ টক—জাতীয় কিছু খাওয়া যাবে না। এতে দাঁত ভালো থাকে ব’লে মনে করেন ম্রোরা। ছেলেরা লম্বা চুল রাখেন, চুড়ো ক’রে খোঁপা বাঁধেন, খোঁপায় চিরুনিও (‘সিরুট’) গুঁজে রাখেন, যেমন রাখেন মেয়েরা। মেয়েরা খোঁপা বাঁধেন মাথার পিছনের দিকে আর ছেলেরা মাথার সামনের দিকে বা বামদিকে খানিকটা হেলিয়ে দিয়ে, তবে খোঁপায় ফুল গুঁজে রাখেন অবিবাহিত তরুণেরাই। ম্রো পুরুষদের চেনা যায় মাথার শাদা বা ধূসর পাগড়ি (‘লাপং’) দেখে। মহিলারা কানের লতির ফুটোয় রুপোর দুলের (‘রাম সেং’) সঙ্গে বিভিনড়ব ফুল ও ভেষজ লতাগুল্ম গুঁজে রাখেন। আজকাল অবশ্য ছেলেদের লম্বা চুল বা খোঁপা দেখা যায় না; তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন পাশ্চাত্যের রংবাহারি সাজপোশাকে। হাটের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একমনে ‘প্লুং’ বা বাঁশি বাজাচ্ছে—এমন কোনও আত্মমগড়ব কিশোরের দেখাও আর পাওয়া যাবে না সহজে।
মাংসি—র শুরুতেই আছে বান্দরবানের দীর্ঘ সর্পিল পথরেখা। হাতছানি—দেওয়া ধূলিধূসর এই পথরেখাও আর পাওয়া যাবে না। এখন বেশিরভাগ পথঘাট পিচঢালা অথবা ইটবিছানো। ছন ও বাঁশের বেড়ার ঘরের ছন সরিয়ে জায়গা ক’রে নিয়েছে টিনের চাল, কোথাও বা উঠে গেছে ইটের দালান। ম্রো ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছেন ইস্কুল—কলেজে, বিশ^বিদ্যালয়েও। তাঁরা নিজেরাই এখন নিজেদের ছবি তুলছেন দামি স্মার্টফোনে। এসবই ইতিবাচক পরিবর্তন, সন্দেহ নেই। এর নেপথ্যে আছে নিশ্চয়ই আর্থিক সচ্ছলতা, দোরগোড়ায়—আসা প্রযুক্তির নানা উপচার। অবশ্য ধর্মান্তরও আরেকটি বড়ো কারণ। মারমাদের মতো ম্রোরা বৌদ্ধধর্মানুসারী হলেও ম্রোরা মূলত ছিলেন প্রকৃতিপূজারি ও সর্বপ্রাণবাদী; এখন অনেকেই ক্রামাধর্ম ও খ্রিষ্টানধর্মে দীক্ষিত, কেউ—কেউ সনাতন রীতিতেই বিশ^াসী। ১৯৮৫—৮৬ সালে ম্রো—জনগোষ্ঠীর কৃতী সাধক মেনলে ম্রো (জ. ১৯৬৪) ম্রো—বর্ণমালা ও ক্রামাধর্ম আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে ক্রামাধর্মাবলম্বী ম্রোরা গোহত্যা—উৎসব (‘চিয়াসদ পই’) পরিত্যাগ করেছেন। কারণ মেনলে ম্রো—র মতে, যে—ধর্মগ্রন্থ খেয়ে ফেলার অপরাধে এই নির্মম গোবধ—উৎসবের সূচনা তা এখন অনাবশ্যক; ম্রোরা পেয়ে গেছেন তাঁদের ধর্ম—ক্রামাধর্ম। এরকম আরও বহু আচারবিশ^াসের রদবদল ঘটেছে; কিছু বিবরণ পাওয়া যাবে ইয়াংঙান ম্রো—র (জ. ১৯৮৬) লেখা ক্রামাধর্মের উৎপত্তি ও ম্রো সমাজ (২০১৯) বইয়ে।
তাহলে কেন আর দেখতে হবে পুরোনো দিনের ফিল্মে—তোলা ছবি, বিশেষত এই ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে? দেখতে হবে আশলে ইতিহাসচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের টানে। বান্দরবানের এক প্রাচীন জুমনির্ভর জনগোষ্ঠীর সামাজিক—সাংস্কৃতিক জীবনবাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ঔৎসুক্য মেটাতে পারে হারিয়ে—যাওয়া দিনের এই রঙিন চিত্রমালা। এখানেই হয়তো মাংসি—র চিরন্তন আবেদন, বা সমকাল—প্রাসঙ্গিকতা।